পিরিয়ডের সময় পেটের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া ও বৈজ্ঞানিক উপায়

 মাসিকের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া এবং মেডিকেল টিপস – জানুন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

 

 



পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব মহিলাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে অনেক মহিলার মাসে কয়েক দিন পেটের ব্যথা ও অস্বস্তি দেখা দেয়। কখনো কখনো ব্যথা এত তীব্র হয় যে দৈনন্দিন কাজও ব্যাহত হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী বলছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে পিরিয়ডের ব্যথাকে ডিসমেনোরিয়া বলা হয়।



✦ পিরিয়ডে ব্যথা হওয়ার কারণ


অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী ব্যাখ্যা করেন যে পিরিয়ডের ব্যথা মূলত দুই প্রকারের হয়-


1. প্রাইমারি ও স্প্যাসমোডিক ডিসমেনোরিয়া


প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়ায় পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে জরায়ু সংকুচিত হয়। জরায়ুর ভেতরে রক্ত জমে এবং রক্ত বের হওয়ার সময় পেশী চাপের কারণে ব্যথা সৃষ্টি হয়। এটি সাধারণত কিশোরী ও তরুণীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।


লক্ষণ:


পিরিয়ডের ১২–২৪ ঘণ্টা আগে ব্যথা শুরু হয়, 

পিরিয়ড শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যথা চলে যায়।




2. সেকেন্ডারি বা কনজেস্টিভ ডিসমেনোরিয়া


সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়ায় ব্যথা তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী। পিরিয়ডের সময় তলপেট ভারী, রক্তপাত বেশি এবং অস্বস্তিকর অনুভূতি থাকে। সাধারণত জরায়ুতে প্রদাহ, ইনফেকশন, টিউমার, পলিপ, অ্যাডিনোমায়োসিস বা ফাইব্রয়েডের কারণে হয়।
এন্ডোমেট্রিওসিসও তীব্র ব্যথার বড় কারণ। জরায়ুর বাইরে রক্ত জমে (চকলেট সিস্ট) তৈরি হতে পারে। সময়ের সাথে ব্যথার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।


সতর্কতা অবলম্বন করবেন কখন:


☑️  ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী এবং তীব্র হলে,
☑️  সাধারণ ব্যথানাশকে না কমলে,
☑️  অতিরিক্ত ব্লিডিং বা রক্ত জমাট বাধলে,
☑️  দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হলে, 




কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত


প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়ার ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যথানাশক খাওয়া যায়।

 কিন্তু সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়ার ক্ষেত্রে গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি। আলট্রাসনোগ্রাফি ও অন্যান্য পরীক্ষা করে ব্যথার মূল কারণ শনাক্ত করা হয়।


দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র ব্যথা, যা সাধারণ ওষুধে কমে না, তা কখনোই উপেক্ষা করা উচিত নয়। অবহেলা এন্ডোমেট্রিওসিস, টিউমার বা অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়।






পিরিয়ডের সময় ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায়?



1. গরম পানির সেঁক


হট ওয়াটার ব্যাগ বা কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে পেটের নিচে রাখলে পেশী শিথিল হয় এবং ব্যথা কমে।


2. গরম চা ও আদা


গরম চা বা কুচি কুচি করা আদা খেলে অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি প্রভাব থেকে পেটের ব্যথা কমতে পারে।


3. হালকা ব্যায়াম ও হাঁটাচলা


হালকা হাঁটাচলা, যোগাসন বা স্ট্রেচিং পেশী শিথিল করে এবং পেটের ব্যথা হ্রাস করে।


4. পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাদ্য


প্রচুর পানি পান এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ ফলমূল খাওয়া জরুরি।



 




বৈজ্ঞানিক ভাবে গবেষণা ভিত্তিক বেথা কমানোর উপায় -




বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চিকিৎসা জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে যে পিরিয়ডের ব্যথা (Dysmenorrhea) কেবল ওষুধেই নয়, বরং সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।  গবেষণায় দেখা গেছে—এমন কিছু খাবার আছে যা শরীরের প্রদাহ কমিয়ে এই প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং ব্যথা অনেকটাই কমাতে পারে।


যেমন-


1. ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার


 (American Journal of Obstetrics & Gynecology, 2019) এর মতে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পেটের ব্যথা কমাতে অনেকটা সহায়ক।
যে সকল খাবারে পাবেন - 


বাদাম, বীজ,আখরোট, ফ্ল্যাক্সসিড, অথবা
সামুদ্রিক মাছ: স্যামন, হেরিং, সার্ডিনস, ম্যাকেরেল




2. ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার


 (European Journal of Nutrition, 2023)–এর একটি মেটা-বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে বেশি পরিমাণে ভিটামিন ডি গ্রহণ করেছেন, তাদের পিরিয়ডের সময় পেটের ব্যথা অনেকাংশে কমেছে। 

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারের উৎস:


মাছ: স্যামন, টুনা, ম্যাকেরেল
মাছের লিভার তেল ও মাংসের লিভার,ডিমের কুসুম ও পনির


প্রতিদিন সূর্য এর রোদ এ  ১৫–২০ মিনিট দাড়িয়ে ও শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করে নিতে পারেন।
 



3. ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার


ভিটামিন ই পেটের ব্যথা হ্রাসে সহায়ক।  Journal of Obstetrics and Gynaecology Research (Japan, 2020)–এর গবেষণা অনুসারে, ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত খেলে পিরিয়ডের সময় অস্বস্তি কমে।


 যে সকল উপাদান এ পাবেন -


বাদাম (হেজেলনাট, চিনাবাদাম)
সবুজ শাকসবজি: পালং শাক, ব্রকলি
ফলমূল: কিউইফ্রুট, আম, টমেটো




4. প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়ানো


২০০৯ সালে (ক্যানাডিয়ান শিশু ও কিশোর স্বাস্থ্য) সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে দুই দিন বা তার বেশি প্রক্রিয়াজাত খাবার খেয়েছেন, তাদের পিরিয়ডের সময় পেটের ব্যথা তুলনামূলকভাবে বেশি। 


এ ধরনের খাবার গুলো হলো :

 চিপস, ডোনাট, বিস্কুট, প্রক্রিয়াজাত মাংস, সোডা পানীয়।




5. অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন সীমিত রাখা


অ্যালকোহল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH, 2021) অনুসারে, মাসিকের সময় অ্যালকোহল সেবন পেট ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা বাড়ায়।
ক্যাফেইন: অতিরিক্ত কফি বা চা ডিহাইড্রেশন সৃষ্টি করে, যার ফলে পেটের ব্যথা আরও বৃদ্ধি পায়।



ব্যথানাশক ওষুধ এর ব্যবহার-


অনেকে পেইন কিলার খেয়ে পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর চেষ্টা করেন। তবে অধ্যপক ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, এটি সবসময় নিরাপদ নয়।
হালকা প্রাইমারি ব্যথার জন্য সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যথানাশক নিরাপদ।


তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা থাকলে, পেইন কিলার শুধুমাত্র ব্যথা দমায়, কিন্তু মূল রোগ নিরাময় হয় না।


দীর্ঘদিন অবহেলায় পেইন কিলার খেলে এন্ডোমেট্রিওসিস, টিউমার বা অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি থাকে।




পরিশেষে, 

 

পিরিয়ডের সময় পেটের ব্যথা স্বাভাবিক হতে পারে, তবে তীব্র, দীর্ঘস্থায়ী বা দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করার মতো ব্যথা কখনোই উপেক্ষা করা উচিত নয়। 


প্রয়োজনে : গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।


সঠিক যত্ন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পিরিয়ডের সময় ব্যথা ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে, এবং মহিলাদের স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবনমান উন্নত করে।

Post a Comment

Previous Post Next Post