রক্তচাপ কেন বাড়ে ও কিভাবে কমানো যায়: কারণ, লক্ষণ ও কার্যকর প্রতিকার

 (Hypertension) (উচ্চ রক্তচাপ): কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধের পূর্ণ গাইড






হাইপারটেনশন (Hypertension) বা উচ্চ রক্তচাপ হলো এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি  শারীরিক সমস্যা, যেখানে ধমনীর (artery) দেয়ালের উপর রক্তের চাপ দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে।

সাধারণত, রক্তচাপের স্বাভাবিক মান হলো ১২০/৮০ mmHg।
যদি এই মান ১৩০/৮৫ mmHg-এর ওপরে দীর্ঘদিন থাকে, তবে সেটি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হিসেবে বিবেচিত হয়।

এটি প্রায়ই কোনও স্পষ্ট উপসর্গ ছাড়াই ধীরে ধীরে তৈরি হয়, তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে বলা হয় —
"Silent Killer" বা “নীরব ঘাতক”, কারণ এটি নিঃশব্দে হৃদ্‌যন্ত্র, কিডনি, চোখ ও মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে।



 উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ :


উচ্চ রক্তচাপকে অনেক সময় ‘নীরব ঘাতক’ (Silent Killer) বলা হয়, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর কোনো স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায় না। অনেকেই না জানতেই দীর্ঘদিন ধরে এই উচ্চ রক্তচাপে ভুগে থাকেন।
তবে রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন-

1.প্রচণ্ড মাথাব্যথা বা মাথা ভার লাগা

2.মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম ভাব


3.চোখে ঝাপসা দেখা


4.বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া


5.ঘাড় বা কাঁধে টান টান ব্যথা


6.বুক ধড়ফড় করা বা হালকা ব্যথা অনুভব


7.কানে গুঞ্জন বা শব্দ শোনা


8.অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা দুর্বল লাগা


9.গুরুতর অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া



এসব উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই রক্তচাপ পরিমাপ করে নিবেন এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করাই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।






✰  উচ্চ রক্তচাপ বা (Hypertension)  কীভাবে কাজ করে?


হৃদ্‌যন্ত্র যখন রক্ত পাম্প করে, তখন রক্তনালীর ভেতরে একটি নির্দিষ্ট চাপ তৈরি হয় — এটিই রক্তচাপ।
এই চাপ দুটি ভাগে প্রকাশ করা হয়:

1. সিস্টোলিক প্রেসার (উপরের সংখ্যা)হৃদ্‌যন্ত্র সংকুচিত হয়ে রক্ত পাম্প করার সময়ের চাপ।

2. ডায়াস্টোলিক প্রেসার (নিচের সংখ্যা): হৃদ্‌যন্ত্র বিশ্রামে থাকাকালে রক্তনালীর ভেতরের চাপ।

যখন রক্তনালী শক্ত, সংকুচিত বা চর্বি জমে সরু হয়ে যায়, তখন রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয় এবং চাপ বেড়ে যায় — এভাবেই গড়ে ওঠে হাইপারটেনশন।

 

 



 ✰ উচ্চ রক্তচাপ বা (Hypertension) এর ধরন


1. প্রাইমারি (Essential) হাইপারটেনশন:


প্রায় ৯০–৯৫% ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না।

ধীরে ধীরে জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস ও বংশগত কারণে তৈরি হয়।

 

 2. সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন

 এটি অন্য কোনও রোগের প্রভাবে হয় — যেমন কিডনি রোগ, হরমোনের অসামঞ্জস্যতা বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়

 





✰ উচ্চ রক্তচাপ বা (Hypertension) এরপ্রধান কারণসমূহ



➤. জীবনযাপনজনিত কারণ

1. অতিরিক্ত লবণ ও প্রক্রিয়াজাত খাবার: অতিরিক্ত সোডিয়াম রক্তনালীর দেয়ালে জল জমিয়ে চাপ বৃদ্ধি করে।

2. চর্বিযুক্ত ও ফাস্ট ফুড: ট্রান্স ফ্যাট ও কোলেস্টেরল রক্তনালী সংকুচিত করে।

3. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: ব্যায়াম না করলে হৃদ্‌যন্ত্র দুর্বল হয়, রক্তচাপ বাড়ে।

4. স্থূলতা: শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে গেলে রক্তনালীর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে।

5. ধূমপান ও অ্যালকোহল: নিকোটিন ও ইথানল রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয়।

6 মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেসে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন বাড়ে, যা রক্তচাপ বৃদ্ধি করে।


✰ জিনগত ও শারীরবৃত্তীয় কারণ

1. বংশগত প্রবণতা: পরিবারে হাইপারটেনশন বা হার্টের রোগ থাকলে ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়।

2. বয়স: বয়স বাড়ার সঙ্গে রক্তনালীর দেয়াল শক্ত ও কম নমনীয় হয়ে পড়ে।

3. লিঙ্গ: ৪৫ বছরের আগে পুরুষদের ঝুঁকি বেশি; মেনোপজের পর নারীদের ঝুঁকি প্রায় সমান হয়ে যায়।


✰. এবং অন্যান্য রোগের প্রভাব


1 ডায়াবেটিস: উচ্চ রক্তে শর্করা রক্তনালীর প্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত করে, রক্তচাপ বাড়ায়।

2. কিডনি রোগ: কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন (Renin-Angiotensin System) ঠিকমতো ব্যালান্স করতে না পারলে চাপ বৃদ্ধি পায়।

3. থাইরয়েড বা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা: হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।

4. স্লিপ অ্যাপনিয়া: ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হওয়া রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে, যা হাইপারটেনশনের অন্যতম কারণ।

 

 


✰  প্রতিকার ও প্রতিরোধ

      (সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ) 


1. লবণ সীমিত করুন: প্রতিদিন ৫ গ্রামের কম লবণ খাওয়া উচিত (প্রায় এক চা-চামচের কম)।

2.নিয়মিত ব্যায়াম করুন: সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন, প্রতিদিন ৩০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম (যেমন brisk walking, সাঁতার, যোগব্যায়াম)।

3. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন: আপনার BMI ১৮.৫–২৪.৯-এর মধ্যে রাখার চেষ্টা করুন।

4. ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণ পরিহার করুন।

5. মানসিক শান্তি বজায় রাখুন: মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, বই পড়া বা গান শোনা উপকারী।

এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন ও ঘুম ঠিক রাখুন।




✰ চিকিৎসা


হাইপারটেনশন সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না হলেও, সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করবেন,

 তবে ওষুধ নিজে নিজেই পরিবর্তন বা বন্ধ করা বিপজ্জনক, কারণ এটি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।




 ✰জটিলতা


নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ রক্তচাপ শরীরের vital organs বা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
1. হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওর
2. স্ট্রোক ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ
3. চোখের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস
4. কিডনি বিকলতা
5. অ্যানিউরিজম (ধমনীর ফোলাভাব)
সুতরাং,হাইপারটেনশন এমন একটি রোগ যা অনেক সময় কোনও সতর্কতা ছাড়াই জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
তবে সুখবর হলো — এটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
 নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা,
 মানসিক প্রশান্তি রাখা এবং,চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই হলো কার্যকর মাধ্যম, 
একটি সুস্থ হৃদয় ও দীর্ঘায়ুর গোপন রহস্য। 
মনে রাখবেন রক্তচাপ বাড়লে নয়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেই বাঁচার নিশ্চয়তা।

Post a Comment

أحدث أقدم